Image-Description
Stories
পুটপুটের গল্প
Feb 13 2024 Posted by : montajpublishing

এই যে শুনছ, আরে হ্যাঁ, তোমাকেই তো ডাকছি! আমি হলাম গিয়ে পুটপুট। আমার ভয়ঙ্কর খটোমটো একটা ভালো নাম আছে বটে, কিন্তু বেশিরভাগ লোকই ওই নামটা বলতে গিয়ে থতমত খায়, তাই সবাই আমায় পুটপুট বলেই ডাকে! 

এই দেখ না, আমি আজ সকাল থেকেই কেমন পলাশডিহির এই বাড়িটার উঠোনে, পেল্লায় আমগাছটার ডালে টাঙানো দোলনায় বসে মজাসে দোল খাচ্ছি। 
কী, খুব অবাক হয়ে গেলে তো!  ভাবছ,কলকাতার সল্টলেকের দোতলার বারান্দায় বসে সারাক্ষণ আপন মনে বকবক করা ছেলেটা, সক্কাল সক্কাল পলাশডিহির বাড়ির উঠোনে দোলনায় দোল খায় কী করে! 
আরে বাবা, সেই গল্পটা বলব বলেই তো তোমায় ডাকছি। 

জানোই তো মাঘের হাড় কাঁপানি শীতটা বিদায় নিতে না নিতেই মা সরস্বতীর মর্ত্যে আসার সময় হয়ে যায়। আমার মা বলেছে, আমরা সবাই ঠিকঠাক পড়াশুনা করছি কিনা সেই খোঁজখবর করতেই তাঁর আসা, তা কষ্ট করে এসেই যখন পড়েন, সেই সুযোগে আমরাও তাঁকে পুজো দিয়ে তুষ্ট করতে চাই, বিদ্যার দেবী তো ! 

এই বছরে মা ঠিক করেছিল, বাড়িতে স্বরস্বতী ঠাকুরের মূর্তি এনে পুজো করা হবে। আমি তো এখন একটু বড় হচ্ছি, ওদিকে আমার নাকি পড়াশুনায় মতিগতি বেশ কম। কী জানি বাবা, আমি তো সেরকম কিছু টের পাই না। তা সে যাই হোক, বাড়িতে পুজো হলে মন্দ কী, বরং মজাই মজা। আগের দিন প্রতিমা আসবে। প্রসাদে ফল,মুড়কি, নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু তো থাকবেই তাছাড়া দুপুরে ভোগের ব্যবস্থাও  থাকবে। ঝিমলিদিদি আর টুকাইদাদারাও আসবে। কী যে আনন্দ হচ্ছিল, কী বলব! 
রোজ সকালে উঠে কর গুণে দেখতাম আর ক'টা দিন বাকি, ঠিক এমন সময়ে বিনা মেঘে বজ্রাঘাত। ভাবছো বুঝি ওই কঠিন শব্দটা বললাম কী করে! 
আরে ওই শব্দটা আগে কোনদিন শুনেছি নাকি, সেইদিনই তো শিখলাম কমলামাসির কাছে। প্রথমে মনে হয়েছিল ব্যাপারটা বুঝি বেশ রোমাঞ্চকর, কিন্তু পরে যখন বুঝলাম, মাকে আবার কয়েকদিনের জন্য বাইরে যেতে হবে, ফলে পুজো মুলতুবি, তখন আমার কান্না দেখে কে! একে তো মাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব মন কেমন করে,তায় আবার এতো সাধের পুজোটাও বন্ধ !
 আসলে হঠাৎ খবর এসেছে মাকে বিদেশের একটা সেমিনারে যোগ দিতে যেতে হবে। মা তো ভয়ঙ্কর একটা দায়িত্বের কাজ করে কিনা, তাই না গিয়ে উপায় নেই। 
আমি তো কেঁদেই আকুল। সব শুনে দাদু আর ঠাম্মা বলল ―
 "কুছপরোয়া নেই, এবারে পলাশডিহির বাড়িতেই দাদুভাইকে নিয়ে এসে মহা ধূমধাম করে পুজো করব আমরা।" 
 
 পলাশডিহিতেই আমাদের আসল বাড়ি। বাবাদের তো ওখানেই জন্ম, পলাশডিহির হাইস্কুলে পড়াশোনা। স্কুল পাশ করে বাবা কলকাতায় এসে ডাক্তারিতে ভর্তি হল। তারপর মেলা পড়াশোনা শেষে  এখন কলকাতাতেই একটা বড়ো হাসপাতালের ডাক্তার। তিনি আমরা এখানে থাকি। বাবা চট্ করে ছুটি পায় না, তাই দাদুই এসেছে আমাকে পলাশডিহিতে নিয়ে যেতে। 

দেখতে দেখতে যাবার দিনটা এসে গেল। আগের  রাতে খাবার টেবিলে বসে বাবা, দাদুকে বলছিল ―
"পুটপুট আজকাল খুব চঞ্চল হয়ে গেছে, তোমাদের খুব জ্বালাবে।"
 দাদু  বলল, "অ, আর তোমরা নিজেরা কী ছিলে ভুলে গেছ বুঝি!"
বাবা চুপ। 
হি হি, এই জন্যই তো  দাদু আর ঠাম্মাকে আমার এত্ত ভালো লাগে। 

পরদিন সক্কালবেলা বাবা এসে আমাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে গেল। ট্রেনে যাওয়ার বিশাল মজা ! কত্ত লোক, ঝালমুড়ি, খেলনাওয়ালা, বাউলগান, যাকে বলে ধুন্ধুমার কান্ডকারখানা। 

চেয়ার কারে আমাদের সিট। জানলার ধারের সিটটা যে আমার, সে কথা তো বলাই বাহুল্য। প্রথমে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সব কিছু দেখতে ব্যস্ত ছিলাম, কিন্তু জানো তো, যখন ট্রেনটা বাঁশি বাজিয়ে ছেড়ে দিল, ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে একা দাঁড়িয়ে থাকা বেচারা বাবার চেহারাটা ক্রমশ ছোটো হয়ে যাচ্ছিল; আমার গলাটা ব্যথা করতে থাকল। দুচোখে জল উপচে উঠেছে, ঠিক তক্ষুনি দাদু বলল, "ট্রেনের ফিরিওয়ালার কাছ থেকে কি কি খেলনা কিনবে ভেবে রেখেছ তো!" আরে তাই তো! চোখ মুছে ভাবতে বসলাম। 
নতুন ধরনের মজার খেলনা কেনাকাটা করে, ঝালছাড়া ঝালমুড়ি খেয়ে আর বাউলগান শুনতে শুনতেই কখন যেন পলাশডিহি পৌঁছে গেলাম। 

পলাশডিহি জায়গাটা বড্ড সুন্দর। একে রাঙামাটির দেশ, তারপর গাছে গাছে ফুটে থাকা পলাশের রঙে চারপাশটা লালে লাল। 

আমাদের নিয়ে যেতে স্টেশনে বুধনকাকা এসেছিল।  বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড়াতেই বিন্দিপিসি ছুট্টে এসে কোলে তুলে নিল। আরে আমি কী বাচ্চা আছি নাকি এখনও! এমন লজ্জা করে! 

আমি এলেই মুংলি, লছমন, বুধিয়া এতোয়ারিয়া, সব্বাই আমার সঙ্গে খেলতে চলে আসে। রোজ সকালে উঠোনে যা হুড়ুদ্দুম খেলা হয় না, কী বলব!

উঠোন পেরিয়ে পিছন দরজা দিয়ে বাইরে গেলেই ধানক্ষেত। বুধনকাকার কাঁধে চড়ে আমি কতদূর ঘুরে আসি! 
কতো নতুন পাখি দেখি, তালগাছে বাবুই পাখির বাসা ঝোলে, দেখতে পাই। আর জানো তো, ক্ষেতে যখন ধান পাকে, তখন তার ভিতর দিয়ে হাওয়া বইলে কেমন ঝমঝম করে বাজনার মতো আওয়াজ হয়। এবার পুজোর সময় এসে সব দেখে গেছি। 
 
বিকেলবেলায় বুধনকাকা একগাদা খড় আর বাঁশ নিয়ে চলে এসেছে। উঠোনে সরস্বতী ঠাকুরের কুটির বানানো হবে, পরশু সকালেই তো পুজো। ওদিকে
বিন্দিপিসি একগাদা রঙিন লাল নীল কাগজ আর বাটি ভর্তি ময়দার আঠা বানিয়ে দিয়ে গেল, আমার বন্ধুর দলও হাজির। সবাই মিলে কত যে রঙিন শিকল বানালাম। অত বড়ো উঠোন সাজানো কী চাট্টিখানি কথা! 
পরদিন একটু বেলার দিকে বুধনকাকা কাউকে কিছু না বলে প্রতিমা আনতে চলে গেছিল। ঠাম্মা খুব রাগারাগি করছিল, পুজোর সব জিনিসপত্তর আনতে হবে, টাকা আর লিষ্টি নিয়ে গেল না!  
তারপর যা হল, তোমরা ভাবতেও পারবে না। 
বেলা গড়িয়ে দুপুরও পার হয় হয়, এমন সময়ে বুধনকাকা প্রতিমাসহ,পুজোর বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরলো, আর সঙ্গে কে এল বলতো!  
বাবা গো, আমার বাবা! বাবা যে আসবে আমরা কেউ জানতামই না। কেবল বুধনকাকাই জানত! বাবা ট্রেন থেকে নেমে, বুধনকাকার সঙ্গে মিলে পুজোর সব বাজার করে, তারপর বাড়ি এসেছে। 
সন্ধ্যাবেলায় বাবা আমাদের তৈরি কাগজের শিকলি দিয়ে পুরো উঠোনটি সাজিয়ে দিল। বুধনকাকা লাইট লাগিয়ে দিল, আর অমনি মা সরস্বতী ঝলমল করে হেসে উঠলেন।
 বাবা এবারে অনেক রঙ পেন্সিলের বাক্স আর ড্রয়িংখাতা এনেছে। কাল দুপুরে সব্বাইকে একটা করে দেওয়া হবে। তারপর আমাদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হবে সারা উঠোন জুড়ে। দাদু বলেছে সব্বাইকে প্রাইজ দেবে। 
 
পুজোর দিন সক্কালবেলা স্নান সেরে, বাবা অনেকগুলো পলাশ ফুল নিয়ে এল। মা সরস্বতী ওই ফুল খুব ভালোবাসেন কিনা, সবাই মিলে অঞ্জলি দেওয়া হল কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার বুধনকাকা আর ঝুমরি এল না। ঠাম্মা চিন্তা করছিল, হঠাৎ একটা ছেলে সাইকেল করে এসে বাবাকে ডেকে নিয়ে গেল।  
দুপুর গড়িয়ে সন্ধে, বাবার দেখা নেই, দাদু বোধহয় কিছু জানে, মুখ গম্ভীর, কানে ফোন।
 
বিন্দিপিসি আমাদের সব্বার আঁকা ছবি, দড়িতে টাঙিয়ে দিয়েছে। আশেপাশের বাড়ি থেকে দাদু ঠাম্মারা, দেখতে চলে এল। একজন দিদা কী সু্ন্দর গান গাইছিল, ঠিক তক্ষুনি বাবাও ফিরল। বুধনকাকার মেয়ে ঝুমরি নাকি, সকালে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। বাবা আর বুধনকাকু ওকে সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দেখে ডাক্তারবাবুরা সবাই ছুটিতে। শুধু মাত্র একজনই ছিলেন। ঝুমরির আবার তক্ষুনি অপারেশন দরকার। তাঁকেই সঙ্গে নিয়ে, বাবা অপারেশন করে ওকে বাঁচিয়েছে। আমার যে কি গর্ব হচ্ছিলো কী বলব। 
 
অনেক রাতে সবাই যখন শুয়ে পড়েছে, বাবা আর ঠাম্মার সঙ্গে আমিও দাওয়ায় বসে ছিলাম। সব আলো নেভানো, ঠাকুরের সামনে একটি মাত্র বড় প্রদীপ জ্বলছে। উঠোনে সাদা আলপনার উপরে আবছা চাঁদের আলো! 
ঠাম্মা বলল, 
"ভাগ্যে তুই এসেছিলি, তাই বুধনের  মেয়েটা বাঁচল!"
উত্তরে বাবা মা স্বরস্বতীর দিকে চেয়ে প্রণাম করল তারপর ধীরে ধীরে বলল
 "এবার থেকে ছুটিছাটায় মাঝে মাঝেই আসতে হবে , ওই অসহায় মানুষগুলোর জন্যই। 
 
অত সব শক্ত কথাবার্তা আমি বুঝি না, শুধু বুঝলাম আমাকেও মন দিয়ে পড়াশোনা করে বাবার মতো বড়ো মানুষ হতে হবে। 

ভাবতেই দেখি মা সরস্বতীর মুখটা যেন আরও হাসি হাসি ঠেকছে।

-সুমিতা দাশগুপ্ত


Popular Books


Comments

  • Shampa Das Gupta .

    Khub e sundor ekti lekha, mon ta bhalo lagaye bhore gelo.

    Feb 13 2024
  • Bijaylakshmi Mukherjee

    বাঃ ভারি সুন্দর

    Feb 14 2024

Write a Comment